ক্ষতিকর ঠান্ডা পানীয় নয় উপকারি ডাবের জল পান করুন, বার্তা বিধান চন্দ্র কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের

মিলন খামারিয়া, কল্যাণী: ২ সেপ্টেম্বর ‘বিশ্ব নারকেল দিবস’ পালিত হল বিধান চন্দ্র কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের (BCKV) কনভোকেশন হলে। ভারত সরকারের ‘কৃষি ও কৃষক কল্যাণ মন্ত্রণালয়’-এর অধীনে চলা ‘নারকেল উন্নয়ন বোর্ড’ ও বিধানচন্দ্র কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের আইসিএআর-এআইসিআরপি অন প্ল্যান্টেশন ক্রপসের যৌথ উদ্যোগে। বিশ্বব্যাপী নারকেলের গুরুত্ব তুলে ধরার জন্য ২০০৯ থেকে এশিয়া-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের আন্তর্জাতিক সংস্থা- এশিয়ান অ্যান্ড প্যাসিফিক কোকোনাট কমিউনিটির উদ্যোগে পালিত হয়ে আসছে দিনটি। যদিও ১৯৯৮ সালেই নারকেল দিবস পালনের প্রস্তাব রাখা হয়। এই সংস্থার প্রধান কার্যালয় ইন্দোনেশিয়ার জাকার্তাতে।

ভারত সহ ১৮টি নারকেল উৎপাদনকারী দেশ এই সংস্থার সদস্য। ইন্দোনেশিয়া, ফিলিপাইন, ব্রাজিল, শ্রীলঙ্কা, পাপুয়া নিউগিনি, মিয়ানমার, মেক্সিকো, থাইল্যান্ড, মালয়েশিয়া, ঘানা, তানজানিয়া, বাংলাদেশের মতো মতো প্রধান নারকেল উৎপাদনকারী দেশগুলির নারকেল চাষী, ব্যবসায়ী ও সংশ্লিষ্ট অংশীদাররা এটি উদযাপন।

নারকেলের উপকারিতা সম্পর্কে সচেতনতা তৈরির জন্য বিভিন্ন অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয় বিশ্ব জুড়ে। দেশী ও বিদেশি বহুজাতিক সংস্থার ক্ষতিকারক ঠান্ডা পানিয়ে না খেয়ে নারকেল বা ডাবের জল খাওয়ার উপর গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। ডাবের জল শরীরকে সতেজ ও আর্দ্র রাখে, ডিহাইড্রেশন কমায় এবং ইলেক্ট্রোলাইটের ভারসাম্য বজায় রাখে। এটি হজমে সাহায্য করে, রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ায়, রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে রাখে এবং ত্বকের জন্য উপকারী। এছাড়াও, ডাবের জল ওজন কমাতে, পেশি শক্তির বাড়াতেও সাহায্য করে।

নারকেল শিল্পের উন্নতির মাধ্যমে দারিদ্র্য দূরীকরণ এবং এই শিল্পে বিনিয়োগে উৎসাহ যোগানোর কাজ করে এপিসিসি। ভারতে প্রতি বছর এই দিনটি ‘কোকোনাট ডেভেলপমেন্ট বোর্ড’-এর তত্ত্বাবধানে পালিত হয়। আন্তর্জাতিক নারকেল সম্প্রদায়(ICC) বিশ্ব নারকেল দিবসের এই বছরের থিম প্রকাশ করেছে -‘নারকেলের শক্তি উন্মোচন, বিশ্বব্যাপী কর্মকাণ্ডের অনুপ্রেরণা’।

এ দিনের আলোচনায় মূলত নব উদ্ভাবনী কৃষি কৌশল, নারকেল গাছের নানান অংশ থেকে তৈরি পণ্যকে আরও বেশি করে কী ভাবে তুলে ধরা যায় এবং তার মাধ্যমে অর্থনৈতিক স্বাবলম্বিতা অর্জনের পথ নিয়ে আলোচনা হয়। উন্নত পদ্ধতিতে নারকেল চাষ নিয়ে আলোচনা করেন অধ্যাপক জীতেশ কুমার হোড়। তিনি নারকেল গাছের বাগানের মধ্যে সাথী ফসল হিসেবে লেবু, বেগুন, কলা, ঝিঙে, হলুদ,আদা ইত্যাদি সব্জি চাষের উপর গুরুত্ব দেন।

অধ্যাপক কুশল রায় ও ডক্টর সুনীতা মহাপাত্র নারকেল গাছের রোগ-পোকা নিয়ে আলোচনা করেন। নারকেল গাছের পাতার সাদা হয়ে যাওয়া, গাছের ফুল পড়ে যাওয়া আটাকনোর বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা করেন তারা।

এনসিসিএসআই -এর চেয়ারম্যান ডক্টর তাপস দে বলেন, আধুনিক কৃষক হতে গেলে পরিকল্পনা করে চাষ করতে হবে। শুধু ডাব বা নারকেলের জন্য নয়, হস্তশিল্পের মাধ্যমে বিভিন্ন দ্রব্য তৈরি করা যেতে পারে নারকেল চাষের মাধ্যমে। নারকেলের মালা, নারকেল ছোবড়া থেকে আমরা আমাদের নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্যাদি তৈরি করে নিতে পারি। আর এই সব কাজ করার জন্য ভারত সরকারের অনেক বোর্ড হয়েছে। চাষিদের উচিত সেই সব জায়গায় যোগাযোগ করে আধুনিক ভাবনায় চাষাবাদ করা, তাতে আয় অনেক বাড়বে।

বিধান চন্দ্র কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইস চ্যান্সেলর অধ্যাপক ডক্টর অশোক কুমার পাত্র বলেন, নারকেল একটি শুভ ফল, একে ‘কল্পবৃক্ষ’ও বলা হয়ে থাকে। ভারতীয় সংস্কৃতিতে অনেক শুভ কাজের পূর্বে নারকেল ফাটানো হয়ে থাকে। শুধুই চাষিরা নয়, আমাদের পরিবারের প্রত্যকের নামে একটি নারকেল চারা রোপণ করা উচিত। নারকেল বহুবর্ষজীবী উদ্ভিদ। লম্বা জাতের নারকেল গাছ সাধারণত ৮০-১০০ বছর পর্যন্ত বাঁচে৷ তাহলে কয়েক প্রজন্ম ধরে সেই পরিবার ফল খেতে পারবে ও পরিবারের আত্মীয়দের স্মৃতি রোমন্থন করতে পারবেন।

বিশ্ববিদ্যালয়ের এআইসিআরপি অন প্ল্যান্টেশন ক্রপস প্রকল্পের আধিকারিক অধ্যাপক অমিতবরণ ষড়ঙ্গী বলেন, হাজার হাজার বছর ধরে প্রাচ্যের দেশ গুলিতে নারকেল চাষ হচ্ছে। আমাদের দেশে দক্ষিণ ভারতের রাজ্যগুলিতে নারকেল চাষ হয়ে থাকে কিন্তু আমাদের রাজ্যে চাষের আকারে তেমন ভাবে হয় না। নারকেল চাষ করে প্রচুর আয় করা যেতে পারে। পাশাপাশি ‘নীরা’ নামে একটি পানীয় নারকেল গাছের ফুলের ডাঁটা থেকে তৈরি করা যায়, যা ভীষণ শক্তিবর্ধক এবং শরীরের জন্য উপকারী। নলেন গুড়ের মতো নারকেল গাছের ফুলের গোড়া থেকে পাওয়া রস থেকেও গুড় তৈরি করা যেতে পারে। নারকেল তেল খাওয়ার জন্য দক্ষিণ ভারতের রাজ্যগুলোতে ব্যবহৃত হয়। নারকেলের প্রভূত গুণের জন্য একে বলা হয় ‘জীবনের বৃক্ষ’।

সিডিবি-এর রাজ্যের ডেপুটি ডিরেক্টর অমিয় দেবনাথ বলেন, এখানে নারকেল গাছ লাগানো হয় বাড়ির জমিতে কিন্তু আমরা চাষ করি না। হেক্টর প্রতি ১৭৭টা নারকেল গাছ লাগানো যেতে পারে। সাধারণ লম্বা ও বেঁটে জাতের গাছের চাষ করা হয়। লম্বা জাতের গাছে ৫-৭ ও বেঁটে জাতের গাছে ৩-৪ বছরে ফল আসে। এছাড়া শঙ্কর জাতের নারকেল গাছও রয়েছে। আমাদের এখানে শঙ্কর ও লম্বা জাতের গাছই সাধারণত লাগানো হয়। বিধান চন্দ্র কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণা লব্ধ ‘কল্যাণী কোকোনাট-১’ হল লম্বা জাতের গাছ।

এই অনুষ্ঠানে সম্মানীয় অতিথি হিসাবে উপস্থিত ছিলেন কলকাতায় আসিএআর-এটিএআরের ডিরেক্টর ডক্টর প্রদীপ দে, স্বাগত ভাষণ দেন ডাইরেক্টর অফ রিসার্চ অধ্যাপক শুভ্র মুখার্জি, সঞ্চালনা করেন স্নাতকোত্তর শিক্ষার অধ্যক্ষ অধ্যাপক শঙ্কর আচার্য ও নারকেল উন্নয়ন পর্ষদের রাজ্যের আধিকারিক শ্রীতমা বিশ্বাস। এছাড়াও উপস্থিত ছিলেন অধ্যাপক আশিস কুমার বণিক, অধ্যাপক নারায়ণ চট্টোপাধ্যায়ের মতো গুণি জনেরা।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *