হরষিত মজুমদার, সহকৃষি অধিকর্তা, মন্তেশ্বর
আমন ধান প্রধানত বৃষ্টি নির্ভর চাষ। চলতি বছরে জুন থেকেই একনাগাড়ে বৃষ্টির ফলে চাষের জন্য প্রয়োজনীয় জলের অভাব হয়নি। এ বছর বৃষ্টির জল প্রথম থেকে পাওয়ায় অনেক অনাবাদী জমিতেও ধান চাষ হয়েছে। চাষের এলাকাও বেড়েছে। আবার রাজ্যের জামালপুর, রায়না, দাসপুর, ঘাটাল ব্লকের মতো বিস্তীর্ণ এলাকার ধানের ক্ষেত নষ্টও হয়ে গিয়েছে বন্যার কারণে। সেক্ষেত্রে বহু জায়গায় ধানের চারা পাঠিয়ে ক্ষতিগ্রস্থ কৃষকদের পাশে দাঁড়িয়েছে পার্শ্ববর্তী ব্লকগুলি।
আগস্টের শেষে ধানের প্রথম চাপান দেওয়া শেষের পথে। এখন পর্যন্ত ধানের যে পাশ কাঠি হয়েছে সেই গুলি থেকে সক্রিয় শীষ হবে। এর পর যে পাটকাঠি হবে তাতে সক্রিয় শীষ আসে না। তাই এই সময় রোগ পোকার প্রতি একটু নজর রাখা উচিত এবং কৌশলে নিয়ন্ত্রণের সুব্যবস্থা করলে আশানুরূপ ধানের ফলন পাওয়া যেতে পারে।
(১) অণু ও খাদ্যোপাদানের ঘাটতি: প্রথমে জমিতে জিঙ্ক ও বোর্ডের অভাব থাকতে পারে। এমন কি পটাশ ও সালফারের অভাবে ধানগাছ লাল হ ওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। এই রকম হলে একটি মিক্সার তৈরি করে স্প্রে করবেন। তাহলে লাল ভাব কেটে যাবে। ১ ব্যারেল বা ১৫ লিটার জলের জন্য প্রয়োজনীয় উপাদান নীচে দেওয়া হল। প্রথমে ১ বা ২ লিটার জলে ভালভাবে গুলে পুনরায় জল মিশিয়ে ১৫ লিটার দ্রবণ করে স্প্রে করবেন। একটু আঠা মেশালে অধিক কার্যকরী হয়। ১৫ লিটার জলের প্রয়োজনীয় উপাদান- MOP– ১০০ গ্রাম, Thiovit-80 WG- ৫০ গ্রাম, Zn EDTA (Chalamin)- ১৫ গ্রাম, বোরণ- (২০) ১৫ গ্রাম।
(২) পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন চাষ: জমি পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন রাখতে হবে। প্রয়োজনে আগাছানাশক চওড়া পাতার জন্য 2-৪ D দিতে পারেন। এছাড়া নমিনী গোল্ড (১০০ মিলি/একর) বা অলমিক্স (৮ গ্রাম/একর ) প্রয়োগ করলে সুফল পাবেন।
(৩) ধানের প্রধান রোগ ও নিয়ন্ত্রণ: (ক) ধানের বাদামী দাগ দেখা যেতে পারে। কার্বেন্ডিজম ও ম্যানকোজেব মিশ্রন (SAAF/Companion) @ ২.৫ গ্রাম / লিটার জলে মিশিয়ে স্প্রে করতে পারেন।
(খ) খোলা পঁচা ও খোলা ধসা রোগের জন্য নেটিভো (টেবুকোনাজল ও ট্রাইফ্লক্সিস্ট্রবিন এর মিশ্রন) @ ১ গ্রাম /লিটার জলে গুলে স্প্রে করলে সুফল পাবেন।
(গ) BLB ও BLS রোগ নিয়ন্ত্রণে র জন্য ভ্যালিডামাইসিন ৩% @ ২ মিলি অথবা স্ট্রেপ্টোসাইক্লিন ট্যাবলেট (স্ট্রেপ্টোমাইসিন ও টেট্রাসাইক্লিন এর মিশ্রন) ১টি / ১০ লিটার জল অথবা টাটকা গোবর ১৫ গ্রাম / লিটার জল, যে কোনও একটি স্প্রে করলে সুফল পাওয়া যায়।
(ঘ) ঝলসা বা ব্লাস্ট রোগ দেখা দিলে পাতা ও পর্ব ঝলসার জন্য ট্রাইসাইক্লাজেল 75%WP @ 0.৫-১.০ গ্রাম গুলে স্প্রে করবেন। গলা জলসা বা নেক ব্লাস্ট দেখা দিলে অইসোপ্রোথিওলেন @১.০ মিলি লিটার জলে ধান বুলানোর আগে স্প্রে করলে সুফল পাওয়া যায়।মনে রাখতে হবে ধানের ফুল বের হলে আর কোনও ওষুধ প্রয়োগ করা যায় না।
(পরের অংশ পরবর্তী সংখ্যায়)
(৪) ধানের কীটশত্রু ও নিয়ন্ত্রণ:
(ক) মাজরা পোকা: মাজরা পোকা দমনের জন্য অ্যাজাডারেকটিন বা নিমতেল ১০০০০ পিপিএম @ ১-২ মিলি /লিটার জল অথবা নিমাস্ত্র, যে কোনও একটি প্রথম থেকে – ১০ দিন অন্তর ২-৩ বার স্প্রে করলে সুফল পাওয়া যায়।
রাসায়নিক হিসাবে ফ্লুবেন্ডামাইড (টেকুমি/ ফেম) @ ২ গ্রাম বা মিলি/৫ লিটার জলে আঠাসহ গুলে স্প্রে করলে সুফল পাওয়া যায়।
(খ) বাদামী শোষক পোকা: এই পোকার আক্রমণ হলে ৮ সারি অন্তর ধান গাছ ২ দিকে ঠেলে মাথায় সিঁথি কাটার মতো করে ফাঁকা করতে হবে। নাইট্রোজেন ঘটিত ইউরিয়া সার প্রয়োগ বন্ধ রাখতে হবে। প্রতি বিঘায় (৩৩ শতক) ৫ কেজি হারে ফাঁকা স্থানে পটাশ সার যেমন MOP প্রয়োগ করতে হবে।
রাসায়নিক হিসাবে ক্লোথায়ানিডিন ৫০ শতাংশ (ড্যানটপ) @ ০.১ গ্রাম/লিটার জল অথবা প্রফেনোফস ৫০ শতাংশ (ক্যারিনা/ কুরাক্রন) @ ১ মিলি / লিটার জলে আঠাসহ গুলে স্প্রে করলে সুফল পাওয়া যায়।
(গ) পাতা মোড়া পোকা: এই পোকা নিয়ন্ত্রণ করতে অ্যাজাডারেকটিন বা নিমতেল ১০০০০ পিপিএম স্প্রে করতে পারেন। রাসায়নিক হিসাবে ল্যামডা সাই-হ্যালোথ্রিন @ ১ মিলি/লিটার জলে গুলে স্প্রে করলে সুফল পাওয়া যায়।
(ঘ) দ’য়ে পোকা: এই পোকা নিয়ন্ত্রণের জন্য থায়োমেথোক্সাম @ ২ মিলি/৫ লিটার জল অথবা ইনডক্সাকার্ব @ ৫ মিলি/৫ লিটার জল, যে কোনও একটি আঠাসহ গুলে স্প্রে করলে সুফল পাওয়া যায়।
(ঙ) ইঁদুর নিয়ন্ত্রণ: ধানের ক্ষেতে ইঁদুর আনাগোনা করলে কৌশলে ইঁদুর তাড়াতে হবে। ইঁদুর খুব সেনসিটিভ প্রাণী। তাই ইঁদুর খেঁকো পেঁচাকে রাতে শিকারের সুবিধা করে দিতে প্রতি বিঘা জমির ৩-৪ টি স্থানে কঞ্চি সহ বাঁশের ডগলা পুঁতে রাখবেন, যাতে পেঁচা তার উপর বসে নির্বিঘ্নে ইঁদুর শিকার করতে পারে।
এছাড়া ইঁদুর যে পথে যাতায়াত করে সেখানে কলা পাতা নীচের দিকে সঙ সাজিয়ে ঝুলিয়ে রাখলে হাওয়ায় নড়াচড়া করবে। ইঁদুর সাপ ভেবে ভয়ে ঐ জমি থেকে পালিয়ে যাবে।
এছাড়া প্রতি বিঘা জমিতে ইঁদুর যাতায়াত স্থানে চায়ের কাপে পরিষ্কার জল রাখুন। প্রথমে খেতে চায় না, পরে খায়। এই জল খেলে, এরপর জলে গুড় মিশিয়ে দ্রবণ চায়ের কাপে রাখতে হবে। এভাবে ইঁদুরের ভয় সরাতে হবে এবং জমির মালিকের উপর বিশ্বাস বাড়াতে হবে।
তার পর ৫০০ মিলি জলে ১০০ মিলি আলকাতরা মিশিয়ে চায়ের কাপে দিতে হবে। জমি মালিককে বিশ্বাস করে যখন চায়ের কাপে মুখ দেবে মুখ ও গোঁফে আলকাতরা জড়িয়ে যাবে। অস্বস্তিতে ইঁদুর ধান গাছ ও আলে মুখ ঘঁষাঘষি করবে। মুখে ঘাঁ হয়ে ইঁদুর মারা যাবে। ফলে মৃত্যু ভয়ে ইঁদুর অন্যত্র পালিয়ে যাবে।