এ ফুলের ভাগ হবে না

পল্লীবাংলার শিশু-কিশোরের চোখ বুঝি আলাদা! শিষ্ট সমাজের মধ্যে বনপুলক তাকে ডাক দেয়। বুনোফুল তাদের জন্যই বোধহয় ফোটে। বনের অ-গরল ফল মুখে নিয়ে তার প্রভূত পরিতৃপ্তি। এই অভিজ্ঞতা যাদের আছে, তারাই চিনতে পারবেন ‘আঁকর কাঁটা’-র সুগন্ধি ফুল। আহা, সেই গন্ধ-অণুর আইসোমার দিয়ে বডি-স্প্রে যদি বানানো যেতো! আছেন কি কোনো রসায়নবিদ? কত চৈতালী বিকেলে অপরাহ্ন-ক্রীড়ার পর এই ফুলের পাপড়ি ভেজা জলে স্নান করে নির্মল সুগন্ধি হয়েছি। নিজেই ভাবতাম, এ কী পাগলামি মোর! আজ ভাবি, নিত্যকালের মধ্যে ঐ মহাস্নান আর ফিরে আসবে না কোনোদিন। খড়দার ওইসব চেনা গাছপালা, বনবাদাড় ঘুরে বেড়ানো দিনগুলি এখন কেবল রোমন্থনের পাতায় আসে।

মনোভূমির প্রত্ন-ইতিহাসে আজকের আলোচনা ‘আইহা গোটা’ বা ‘আঁকড় কাঁটা’ ফুল এবং তার ফল। এই ফল মে মাসে লালচে কালো অথবা মেরুন-রঙা হয়ে পাকে, ‘বুনো আঁশফল’ নামে খেয়েছি বহুবার। পাকা ফলের সৌন্দর্যে মোহিত হয়ে গিয়ে টেবিলের শূণ্য দোয়াতখানিতে এক ডাল সাজিয়েও রেখে দিতাম।

পালপার্বণে সাজি নিয়ে সবান্ধব বুনো ফুল কুড়োতে যাওয়া ছিল আমাদের শখ, অনেকটা Biodiversity-walk। শিবরাত্রির সময় তুলতে যেতাম আকন্দ, শ্বেত আকন্দ, ধুতুরা, বেলপাতা, নীলকন্ঠ। তখন ভাঁটফুল সবে ফুটতে শুরু করে, কখনও পাই, কখনও পাই না। কিন্তু মুণ্ডিতমস্তক আঁকড় কাঁটার পত্রহীন ডালে উঁকি দিয়ে দেখি এসেছে তার সবজে মুকুল। তারই কয়েকটিতে সাদা পাপড়ি খুলে এসে বহির্ভাগে বেঁকে রয়েছে, আর বেরিয়ে এসেছে ফুলের অসংখ্য সাদা পুংকেশরচক্র, সঙ্গে সোজা রেখার আকারে গর্ভকেশর। আমরা তিন বন্ধু এক পরিচিত বৃদ্ধ পুরোহিতের কাছ থেকে সম্মতি আদায় করে নিয়েছিলাম, আমাদের মনজিনিস আরও কয়েকটা ফুল শিবের পূজার জন্য অনুমোদন দিতে হবে। কারণ শাস্ত্রে তার যে স্বীকৃতি নেই! তবুও আমাদের ভালোলাগা ফুলগুলি যেন শিবের পুজোয় লাগে। নতুন করে ওই পুরোহিত সেদিন যে যে ফুলকে অনুমোদন দিলেন, আঁকর কাঁটা তার অন্যতম। আর ছিল কালকাসুন্দা, বন-বোতাম, বন-শিউলি।

এক হিন্দিভাষী জনমজুর এই গাছটির নাম বলেছিলেন ‘আঁকল’। হ্যাঁ ‘আঁকোলাম’ নামে কেরালায় এবং ‘আঁকোলা’ নামে কর্ণাটকের মানুষ গাছটিকে চেনেন। এর ইংরেজি নাম Sage leaved Alangium, বিজ্ঞানসম্মত নাম Alangium salviifolium. এটি কর্ণেসী (Cornaceae) পরিবারের অন্তর্ভুক্ত ঘন, ঝোপাকৃতির অনুচ্চ-বৃক্ষ, ক্ষুদ্র তার গুঁড়ি। আগে পথের ধারে অহরহ হয়ে থাকতো বীজ থেকে জন্ম নেওয়া গাছগুলি। শুকনো মরুময় জমিতে, নদীর বালিভূমির পাড়ে, অনুচ্চ পাহাড় মালভূমিতে এই গাছ একদা স্বাভাবিক উদ্ভিদ ছিল। এখনও গাঁ-গঞ্জে কোথাও কোথাও এই গাছ লভ্য। কোথাও এই গাছেই গৃহের বেড়ার আব্রু।

এরই মিষ্টি গন্ধের ফুল ফোটে ফেব্রুয়ারী থেকে এপ্রিল মাসে, ফল পাকতে থাকে এপ্রিল থেকে মে-জুন নাগাদ। যখন ফুল ফোটে তখন গাছে একটিও পাতা থাকে না। ফল ধরতে ধরতেই বসন্তের ডাকে পাতা মেলে ধরে। যখন সবুজ মার্বেল আকারের ফলগুলি কালোয় রূপান্তরিত হয়ে থাকে, তখন গাছ সুন্দর সবুজ পাতায় পুরোপুরি ঢাকা। তখন কে বলবে, এ গাছই সেই গাছ! এগাছে ফুল ফুটলে অনেক প্রজাপতি আসতো। আর আসতো ছোটো-ছোটো পাখি মধু আর মকরন্দের লোভে। কী সেই পাখি? হ্যাঁ এই ফুলের দিকে তাকিয়ে আমি খড়দহতে প্রথম চিনলাম মৌটুসীকে (Purple rumped Sunbird)। আসতো টুনটুনি, মেটে-ঠোঁট ফুলঝুরি (Pale-billed flowerpecker)। ফল পাকলে গাছে গাছে কোকিল, ছিট কোকিল, বুলবুলি, শালিখ, গো-শালিখ আর টিয়া। গাছে গাছে শাখামৃগ। আর শাখামৃগের পরবর্তী জনমের আমরা ছেলের দল। আজ তাদের অনেকেই খড়দায় বজরংবলীজীর ভক্ত। নগরে এই ফুলের, এই ফলের ভাগ যদি সত্যিই চান, তবে শহরের মাঝে কিছু বুনো হারিয়ে যাওয়া এমন গাছের উদ্যান গড়ে তুলুন।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *