বেগুনের অনেক গুণ: ঝোল সেদ্ধ ভাজা কমায় অনেক রোগ, কী ভাবে বাড়বে ফলন জেনে নিন

শ্যামসুন্দর দোলোই

হিসেবি শব্দের আগে ‘বে’ যোগ করলে বিপরীত অর্থ হয়ে যায় কিন্তু গুণ-এর পূর্বে ‘বে’ বসালে উল্টো রূপ ধারণ করে না। বরং এটি একটি গুণসম্পন্ন উপকারী সবজি হয়ে যায়, ‘বেগুন’।  অনেক রসিক জন একে গুণহীন বললেও বাস্তবে তা নয়।

একথা বলার কারণ, বেগুন ঝোলে পড়লে সবজিটি, আমাদের আমাদের পরিপাক ক্রিয়ায় সহায়ক হয়ে ওঠে। এটি অ্যান্টিবায়োটিক সবজি । রক্তে শর্করার মাত্রাও নিয়ন্ত্রণ করতে সাহায্য করে। রক্তের লোহিত কণিকার মাত্রাও বাড়ায়।

আবার বেগুন সেদ্ধ জল পান করা অ্যানিমিয়া প্রতিরোধে সহায়ক হয়ে ওঠে। বেগুন পোড়া খেলে দেহের অনাবশ্যক মেদ কমাতে সাহায্য করে স্থূলতা নিয়ন্ত্রণ করে। দেহের গড়ন স্লিম বা রোগাপাতলা হতে সাহায্য করে। প্রস্রাব পরিশ্রুত করে। কিডনির ছোট পাথর গুলিয়ে প্রস্রাবের সঙ্গে বার করতে সহায়ক হয়। সাদা বেগুন অর্শ রোগেও উপকারী।

তেলেভাজা বেগুন বাতের উপশম ঘটাতে পারে। মধু মেশানো বেগুন পোড়া খেলে ঘুম গাড় হয়। এতে অ্যান্থোসায়ানিন থাকায় ক্যান্সারকেও প্রতিরোধ করার চেষ্টা করে। অবশ্য অনেকের ক্ষেত্রে বেগুন খেলে এলার্জি, চামড়ায় চুলকানির উদ্রেগ দেখা যায়। এক্ষেত্রে নিমপাতা সহযোগে বেগুন ভাজা বা অন্য কোনও ভাবে খাওয়া যেতে পারে।

বেগুনের খাদ্য উপাদান:

১০০ গ্রাম খাদ্যোপযোগী বেগুনে, ভিটামিন এ ০.১২৪ অ্যাঙস্ট্রম ইউনিট, ভিটামিন বি ওয়ান‌ ০.০৪ মিলি গ্রাম, ভিটামিন বি টু‌ ০.১১ মিলি গ্রাম, ভিটামিন বি ৫ থাকে ০.৯ মিলিগ্রাম, ভিটামিন সি থাকে ১২ মিলিগ্রাম, ক্যালসিয়াম ১৮ মিলিগ্রাম, পটাশিয়াম ২০০ মিলিগ্রাম, ম্যাগনেসিয়াম ১৬ মিলিগ্রাম, আয়রণ ৯ মিলিগ্রাম, সোডিয়াম ০.৩ মিলিগ্রাম, কপার ০.১৭ মিলিগ্রাম, ফসফরাস ৪৭ মিলিগ্রাম, সালফার ৪৪ মিলিগ্রাম, ক্লোরিন ৩২ মিলিগ্রাম, অক্সালিক অ্যাসিড ১৮ মিলিগ্রাম, প্রোটিন ১.৪ গ্রাম, ফ্যাট ০.৫ গ্রাম, অন্য খনিজ পদার্থ ০.৩ গ্রাম, ফাইবার ১.৩ গ্রাম, কার্বোহাইড্রেট ৪ গ্রাম এবং জল ৯৩ গ্রাম থাকে।  এবং এ থেকে মোট খাদ্য শক্তি পাওয়া যায় ২৪ কিলো ক্যালোরি।

বেগুন চাষ:

সারা বছরে  দু-তিন বার বেগুন চাষ করা যায়। তবে বর্ষাকালীন চাষে জল সেচ কম লাগে এবং এই সময় অন্যান্য সবজির ঘাটতি থাকায় উৎপাদনে আয় বেশি হতে পারে।‌ এজন্য উন্নত জাতের বেগুন গাছের চারা রোপন করা উচিত। বর্তমান যুগপোযোগী উন্নত জাত হল- গ্রীষ্মকালীন ক্ষেত্রে পুসা পারপল, ক্লাস্টার, কুন্তল ও চৈতালি ইত্যাদি এবং বর্ষাকালীন ক্ষেত্রে পুসা পারপল লং, কুলি, হাইব্রিড প্রজাতির পুসা আনমোল, হাইব্রিড-৫৬, এম এইচ বি-১, এম এইচ বি-৫৬, সুপ্রিয়া, সুচিত্রা, গ্রিন হাইব্রিড ইত্যাদি।

বীজ তলা তৈরি:

উঁচু জমিতে জ্যৈষ্ঠ মাসের অর্ধেক থেকে আষাঢ় মাসের অর্ধেক পর্যন্ত বীজ বোনার জন্য আদর্শ সময়। বীজ বোনার আগে প্রতি কেজি বীজের জন্য দুই থেকে তিন গ্রাম ক্যাপ্টান, কার্বেন্ডাজিম কিংবা থাইরাম জাতীয় ঔষধ বীজের সঙ্গে মিশিয়ে বদ্ধ পাত্রে কয়েক মিনিট ঝাঁকিয়ে নিয়ে অথবা কার্বেন্ডাজিম ৫০ শতাংশ দুই গ্রাম প্রতি লিটার জলে গুলে আধা ঘণ্টা ডুবিয়ে রেখে শোধন করা হয়। বীজ তলাতেও খড় কিংবা শুকনো পাতা পুড়িয়ে কিম্বা স্বচ্ছ পলিথিন দিয়ে ১০-১২ দিন ঢেকে রেখে মাটির জীবাণু মুক্ত করা যেতে পারে।

এরপর এক কাঠা জমিতে বেগুন চাষের জন্য তিন থেকে সাড়ে তিন গ্রাম বীজ লাগে। বিজ তলায় পোকা নিয়ন্ত্রণে এক সপ্তাহ পর প্রতি লিটার জলে চার গ্রাম কপার অক্সিক্লোরাইড জাতীয় ছত্রাক নাশক ও দুই মিলি নিম তেল স্প্রে করা প্রয়োজন। চারা তোলার প্রায় এক সপ্তাহ পূর্বেও স্প্রে করে নেওয়া ভাল। এই বীজতলা থেকে চার সপ্তাহ পরেই ৩-৪ টি পাতা হলেই মূল জমিতে রোপন করা যায় ।

চারা রোপণের আগে মূল জমিতে বিঘা প্রতি ১৫ থেকে ২০ কুইন্টাল জৈব সার দিয়ে ৭ দিন পরে ২ কেজি পিএসবি এবং ২ কেজি অ্যাজোটোব্যাক্টর মাটির সঙ্গে মেশালে উর্বরতা অনেক বেড়ে যাবে। এরপর প্রতিবিঘায় ১০ কেজি নাইট্রোজেন, ১৩ কেজি ফসফরাস এবং ৬.৫ কেজি পটাশ সার মূল জমিতে ছড়িয়ে দিয়ে চূড়ান্ত চাষ‌ দিতে হয়।

কিছুদিন পর এই মাটিতে ২ফুট × ২ফুট দূরত্বের সারিতে চারা রোপন করা প্রয়োজন। জমিতে আগাছা নিয়ন্ত্রণ করতে হবে নিয়মিত। চারা রোপণের এক মাস ও দেড় মাসের মাথায় চাপান সার প্রয়োগ করলে বেগুন গাছের দ্রুততর বৃদ্ধি লক্ষ্য করা যায়। ফুল ধরার সময় গাছে ডোঙ্গা ছিদ্রকারী এবং পাতায় হলুদ রঙের পোকা আক্রমণ করলে সেই পাতা ছিঁড়ে, আক্রান্ত ডাঁটা ভেঙে পোকা পিষে মেরে ফেলাই ভাল।

আবার এই সময় উড়ো পোকাও আক্রমণ করতে পারে। এজন্য কীটনাশক স্প্রে করা প্রয়োজন। বেশি রোগাক্রান্ত কিংবা মূল কাণ্ডে পচন ধরে গেলে তা উপড়ে ফেলাই ভাল না হলে তা বাকি গাছে ছড়িয়ে পড়বে দ্রুত। বেগুনে কাটা, ফাটা দাগ ধরলে অনুখাদ্য হিসেবে বোরণ ২০ শতাংশ প্রতি লিটার জলে ১ গ্রাম হারে মিশিয়ে ৩০ দিন অন্তর স্প্রে করতে হয়। ‌বেগুন গাছের পাতা কমলা বা হলুদ কিম্বা বাদামী বর্ণ ধারণ করতে থাকলে অথবা কচি পাতা কুঁকড়ে তুলসী পাতা রূপ হতে থাকলে প্রতি লিটার জলে ১ থেকে ২ গ্রাম জিংক গুলে রোপনের প্রথম ২০ থেকে ২১ দিন পর এবং পরে ৪০ থেকে ৪৫ দিন পর স্প্রে করে গাছকে ভিজিয়ে দেওয়া প্রয়োজন ।‌

এভাবে চাষ করলে এবং আবহাওয়া অনুকূল থাকলে বিশেষ করে তাপমাত্রা ২৫-৩০ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেডের মধ্যে যদি থাকে আশানুরূপ ফলন মিলতে পারে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *