‘SIR আতঙ্কে’ ফের আত্মহত্যা প্রবীণের — ইলামবাজারে চাঞ্চল্য, আতঙ্কে গোটা রাজ্য

নিজস্ব সংবাদদাতা | বীরভূম, ৩১ অক্টোবর ২০২৫

‘স্বচ্ছ ভোটার তালিকা তৈরির নামে’ ফের ছড়াল মৃত্যু-আতঙ্ক। পশ্চিমবঙ্গজুড়ে “SIR আতঙ্ক”-এর আবহের মধ্যেই ফের আত্মহত্যা করলেন এক প্রবীণ নাগরিক। ভোটার তালিকা থেকে নাম বাদ পড়তে পারে — এই আশঙ্কাতেই নিজের প্রাণ নিলেন ৯৫ বছরের ক্ষিতীশ মজুমদার। ঘটনায় শোকের ছায়া নেমেছে পরিবারে, আর চাঞ্চল্য ছড়িয়েছে গোটা রাজ্য জুড়ে।


🔹 ইলামবাজারে ‘SIR আতঙ্কে’ প্রবীণের আত্মঘাতী

পুলিশ সূত্রে জানা গিয়েছে, মৃত ক্ষিতীশ মজুমদার পশ্চিম মেদিনীপুরের বাসিন্দা। কয়েক মাস ধরে মেয়ের বাড়িতে ছিলেন বীরভূম জেলার ইলামবাজার ব্লকের স্কুলবাগান সুভাষপল্লি গ্রামে। বুধবার রাতে নিজের ঘরেই গলায় দড়ি দিয়ে আত্মহত্যা করেন তিনি। বৃহস্পতিবার সকালে পরিবারের সদস্যরা ঝুলন্ত দেহ দেখতে পেয়ে পুলিশে খবর দেন। ইলামবাজার থানার পুলিশ দেহ উদ্ধার করে ময়নাতদন্তে পাঠিয়েছে।

পরিবারের দাবি, কয়েকদিন ধরে বৃদ্ধ প্রবল মানসিক চাপে ছিলেন। মেয়ের মেয়ে নির্মলা মজুমদার বলেন,

“সবাই বলছিল, SIR যাচাইয়ে নাম না থাকলে বাংলাদেশে পাঠিয়ে দেবে। দাদু বারবার বলতেন, ‘আমার নাম যদি না থাকে? আমাকেও কি ফেরত পাঠাবে?’ এই ভয়ই শেষ করে দিল ওঁকে।”


🔹 বাংলাদেশ থেকে পশ্চিমবঙ্গে, তিন দশকের পুরনো ইতিহাস

তদন্তে জানা গিয়েছে, ক্ষিতীশবাবু প্রায় তিন দশক আগে বাংলাদেশ থেকে পশ্চিমবঙ্গে চলে আসেন। পশ্চিম মেদিনীপুরে বসবাস শুরু করে বহুবার ভোটও দিয়েছেন। তবে সম্প্রতি গ্রামে গুজব ছড়িয়েছিল — “২০০২ সালের ভোটার তালিকায় নাম না থাকলে নাগরিকত্ব যাচাইয়ে বাদ পড়বেন।”
এই ভয়ই তাঁর মনে গভীর আতঙ্ক তৈরি করেছিল বলে পরিবারের অভিযোগ।


🔹 আগেও ‘SIR আতঙ্কে’ প্রাণ গেছে পানিহাটিতে

এই ঘটনাটি অনেকের মনে করিয়ে দিয়েছে উত্তর ২৪ পরগনার পানিহাটির প্রদীপ করের আত্মহত্যার ঘটনাকে। সেই ঘটনাতেও আত্মহত্যার কারণ হিসেবে উঠে এসেছিল এনআরসি ও SIR আতঙ্ক। প্রদীপবাবুর রেখে যাওয়া চিঠিতে লেখা ছিল —

“আমাকে যদি বাংলাদেশে পাঠায়, আমি বাঁচব না।”

রাজনৈতিক মহলে সেই ঘটনার পর তীব্র প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়েছিল। তৃণমূল করেছিল প্রতিবাদ মিছিল, আর সিপিআইএম নেতা শতরূপ ঘোষ বলেছিলেন, “স্লোগান চুরি করছে শাসক দল।”


🔹 প্রশাসনের দাবি— “গুজব, আতঙ্ক নয়”

বীরভূম জেলা প্রশাসনের এক আধিকারিক জানিয়েছেন,

“SIR বা Special Intensive Revision হল ভোটার তালিকার নিয়মিত পর্যালোচনার অংশ।
নাগরিকত্ব নিয়ে কারও আতঙ্কিত হওয়ার কিছু নেই। নাম বাদ গেলে সংশোধনের সুযোগও থাকে।”

অন্যদিকে তৃণমূলের বক্তব্য,

“যেদিন থেকে এনআরসি–SIR কথাটা মানুষের কানে গিয়েছে, সেইদিন থেকেই আতঙ্ক শুরু। এই মৃত্যুগুলির দায় বিজেপি সরকারের।”

বিজেপি পাল্টা দাবি করেছে —

“রাজনৈতিক স্বার্থে গুজব ছড়ানো হচ্ছে। SIR সম্পূর্ণ প্রশাসনিক প্রক্রিয়া।”


🔹 মানবাধিকার কর্মীদের দাবি— পূর্ণাঙ্গ তদন্ত হোক

ইলামবাজারের এই ঘটনায় ক্ষোভ ছড়িয়েছে মানবাধিকার সংগঠনগুলির মধ্যে। তাঁদের দাবি, “সরকারি প্রক্রিয়ার ব্যাখ্যা সঠিকভাবে পৌঁছে না দেওয়াই এই মৃত্যুর মূল কারণ। ভয় ও বিভ্রান্তির শিকার হচ্ছে সাধারণ মানুষ।”

মনোবিজ্ঞানীদের মতে,

“যখন রাজনৈতিক প্রক্রিয়ার সঙ্গে নাগরিক নিরাপত্তার প্রশ্ন মিশে যায়, তখন প্রবীণ ও গ্রামীণ মানুষ মানসিকভাবে সবচেয়ে বেশি আঘাত পান। প্রশাসনের উচিত সংবেদনশীল প্রচার।”


🔹 ‘SIR আতঙ্ক’ এখন রাজ্যের মানসিক সঙ্কট

রাজ্যজুড়ে বাড়ছে নাগরিক আতঙ্ক, ছড়াচ্ছে গুজব। প্রশ্ন উঠছে—
🔸 “স্বচ্ছ ভোটার তালিকা তৈরির প্রচেষ্টা কতটা মানবিক?”
🔸 “মানুষের মন থেকে ভয় দূর করতে সরকার কতটা সক্ষম?”

ইলামবাজারের ক্ষিতীশ মজুমদারের মৃত্যু তাই কেবল এক প্রবীণের আত্মহত্যা নয়—
এটি বাংলার গ্রামীণ জীবনে তৈরি হওয়া এক অদৃশ্য মানসিক সংকটের প্রতিচ্ছবি।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *