লিচু বাংলা সহ ভারত তথা দক্ষিণ এশিয়ার অন্যতম জনপ্রিয় ফল। ফল হিসাবে লিচুর পুষ্টিগুন ও স্বাদ অতুলনীয়। কিন্তু নানা কারণে লিচু চাষীরা প্রতি বছর অনেকটা ক্ষতির মুখেও পড়েন। কারণ ১) রোগ পোকার আক্রমণ এবং ২) ঝড়, শিলাবৃষ্টি বা অনাবৃষ্টির মতো প্রাকৃতিক কারণ। তবে সঠিক পরিচর্চা ও রোগ পোকা দমন করে ক্ষতি আংশিক কমানো যায়। নিচে লিচু চাষে আয় বাড়ানোর জন্য কিছু পদ্ধতি আলোচনা করা হল:
ফল না ধরা ও ঝরে পড়ার কারণ:
(১) লিচু গাছে সাধারণত এক বছর ছাড়া ভাল ফলন দেখা যায়। ২) একই ছড়ায় অনেক গুলি ফল ধারন। ৩) সুষম পুষ্টির অভাব। ৪) ঝড়, শিলাবৃষ্টি। ৫) খরা, মাটিতে রসের অভাব। ৬) হরমোনের সমস্যা। ৭) রোগ ও পোকা মাকড়ের অক্রমণ ইত্যাদি।
ফলন্ত লিচু গাছের যত্ন পরিচর্যা ও ফল ঝরা রোধ করণিয়:
(১) সুষম সারের ব্যবহার করতে হবে। একটি ৫- ১০ বছরের লিচু গাছে জৈব সার ২৫-৪০ কেজি, ইউরিয়া ৬০০ গ্রাম, টি.এস.পি ৫০০ গ্রাম, এম.পি ২৫০ গ্রাম মিশ্রণ করে ৩ ভাগে ভাগ করে প্রতি বছর ফেব্রুয়ারি, মে ও আগষ্ট মাসে মোট ৩ বার প্রয়োগ করতে হবে। দুপুর বেলা গাছের ছায়া যতটুকু স্থানে পড়ে সেটুকু স্থানে মাটি কুপিয়ে আলগা করে সার প্রয়োগ করতে হবে। গাছে যদি জিংকের অভাব দেখা যায় অর্থাৎ পাতা যদি তামাটে রং ধারণ করে তবে প্রতি বছর ৫০০ লিটার জলে ২ কেজি জলান্বিত চুন ও ৪ কেজি জিংক সালফেট গুলিয়ে বসন্তকালে গাছে ছেটাতে হবে।
উপরে উল্লিখিত সারগুলি গাছের বয়স ৫ বছরের নিচে হলে তার অর্ধেক এবং গাছের বয়স ১০ বছরের বেশি হলে, দেড়গুণ সার প্রয়োগ করতে হবে। (২) খরার সময় গাছে সেচ দিতে হবে। মাটির ধরন অনুসারে খরার সময় ১০-১৫ দিন পর পর সেচ দিতে হয়। (৩) লিচুর বাগান আগাছা মুক্ত রাখতে হবে। লিচুর শিকড় গভীর ভাবে আমের মত মাটির নীচে প্রবেশ করে না। তাই বছরে ৩-৪ বার অগভীর ভাবে চাষ দিলেই হয়। (৪) গাছের গোড়ায় গরু-মহিষ বাঁধা বা মানুষ চলাচলের পথ রাখা যাবে না। (৫) ফল খুব ছোট থাকা অবস্থায় প্রতি ৪.৫ লিটার জলে ১ মিলি প্লানোফিক্র ১ থেকে ২ বার স্প্রে করলে ফল ঝরা বন্ধ হয়। (৬) জিংক সালফেট দ্রবণের সাথে ২,৪-ডি (১৫ পিপিএম) স্প্রে করে ফল ঝরা কমানো যায়।
পোকা দমন:
লিচুর মাইটস- এটি লিচুর জন্য সব চেয়ে ক্ষতিকারক। এর কারণে লিচুল ফল শূন্য হয়ে যেতে পারে।
মাইটস পোকা আক্রমণের লক্ষণ:
(ক) অতি ক্ষুদ্র সাদা রং এর মাইট পাতার পিছনে বাদামি ভেলভেট তৈরf করে বসবাস করে।
(খ) এতে পাতা পুরু হয়, দুমড়িয়ে থাকে এবং মারা যায়।
(গ) এরা পাতা নিচের দিক থেকে খায়।
(ঘ) সাধারণত মার্চ থেকে জুলাই মাসে এদের আক্রমণ বেশি দেখা যায়।
দমন প্রক্রিয়া: (১) সালফার (গন্ধক) চুর্ণ প্রয়োগ করে এই পোকা মাকড় দমন করা যায়। (২) গাছে নতুন পাতা বের হওয়ার সাথে সাথে কেলথেইন ০.১২ % হারে ৩ সপ্তাহ পর পর ২-৩ বার স্প্রে করতে হবে অথবা ডাইমেথোয়েট ০.০৫ % হারে ব্যবহার করা যেতে পারে। (৩) মেটাসিস্টক্র ০.২ % হারে ব্যবহার করেও উকার পাওয়া যায়।
বাকল খেকো পোকা:
লক্ষণ: (ক) মে জুন মাসে পূর্ণ বয়স্ক প্রজাপতি গাছের গায়ে ডিম পাড়ে। (খ) ডিম ফুটে লার্ভা বের হয় এবং এগুলি বাকল খেতে শুরু করে এবং গাছে ছিদ্র করে দেয়। (গ) আক্রান্ত ডাল দুর্বল হয় এবং ফল ঝরে পড়ে।
দমন ব্যবস্থা: (১) বাগান পরিস্কার পরিছন্ন রাখতে হবে। (২) ডালের ছিদ্র থাকলে পেট্টোল ঢেলে বা ফরমালিন ঢেলে এবং পরে মাটি বা মোম দিয়ে গর্তের মুখ বন্ধ করে দিতে হবে।
লিচুর বীজ ছিদ্রকারী পোকা:
ক্ষতির প্রকৃতি: (ক) এ পোকার ক্ষুদ্র কীট ফলের বোঁটার প্রান্ত দিয়ে বীজের মধ্যে প্রবেশ করে। (খ) এর আক্রমণের ফলে এক ধরনের বাদামী গুড়া (পিঁপড়ের মাটির মত) দেখতে পাওয়া যায়। (ঘ) পাকা ফল ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে খাওয়ার অযোগ্য হয় এবং বাজার দাম কমে যায়। (ঘ) ফল পাকার সময় মেঘলা আকাশ ও বৃষ্টিপাত হলে এ পোকার আক্রমণ বেশি হয়।
দমন ব্যবস্থা: (১) ফল পাড়ার পর অবশিটাংশ পুড়িয়ে ফেলতে হবে। (২) বাগান আগাছা মুক্ত রাখতে হবে এবং ঝোপ-ঝাড় রাখা যাবে না। (৩) এ পোকার আক্রমণ হয়ে গেলে ডাইমেক্রম ১ মিলি প্রতি লিটার ( ১ লিটার জলে) মিশিয়ে অথবা ম্যালাথিয়ন ০.১ % হারে জলে দিয়ে ফল পুষ্ট হবার ১৫ দিন আগে স্প্রে করতে হবে।
বাদুড়ের সমস্যা:
প্রতি বছর বাদুড়ের কারণে প্রচুর পরিমান ফল নষ্ট হয়। এরা ফল পাকা শুরু হলে সাধারণত রাতে ডালে ডালে ঝুলে পাকা ফল খেতে থাকে। বর্তমানে বাদুড়ের মাধ্যমে অনেক প্রকার রোগ ছড়িয়ে পড়ছে। তাই বাদুড় তাড়িয়ে ফল রক্ষা ও রোগ থেকে মুক্তি ব্যবস্থা করা অতি প্রয়োজন।
দমন ব্যবস্থা:
লিচু পাকার সময় ফল রক্ষার জন্য বিশেষ ব্যবস্থা নিতে হবে। আমাদের দেশে প্রচলিত ও সহজ উপায়গুলি হল: (১) ঢোল ও টিন পিটানো (২) পটকা ফোটানো (৪) গাছ ও বাগান যতটা সম্ভব জাল দিয়ে ঘিরে রাখা ইত্যাদি।
লিচুর নানান রোগ দমন:
ফল পচা বা ফ্রট রট:
এ রোগ এক প্রকার ছত্রাক দ্বারা ছড়ায়।
রোগের লক্ষণসমূহ: (ক) প্রথমে ফলের উপর ছিটা ছিটা দাগ পড়ে। (খ) সেই দাগ এক সঙ্গে হয়ে বড় আকার ধারণ করে এবং কালো বর্ণ হয়ে যায় (গ) ফল শুকিয়ে যায় এবং এক পর্যায়ে ঝরে পড়ে।
দমন ব্যবস্থা: (১) শুকনো ডালপালা বা অবশিষ্ট অংশ পুড়িয়ে ফেলতে হবে। (২) ফলে বোর্দোমিক্রার ও ডাইথেন এম-৪৫ প্রয়োগ করতে হবে।
পোকামাকড় দমন:
আমের শোষক পোকা/ আমের হপার (Mango hopper)
এই পোকার ৩টি প্রজাতি ক্ষতি করে থাকে। নিচে ক্ষতির প্রকৃতি ও দমন ব্যবস্থা দেওয়া হল।
ক্ষতির প্রকৃতি: লিচুর অনিষ্টকারী পোকার মধ্যে এ পোকা সব চেয়ে বেশি ক্ষতি করে। আমের পাতা ও বোটায় এরা ডিম পাড়ে। ফলে পাতা ও ফুল শুকিয়ে যায় এবং গুটি আসার আগেই ফুল ঝরে যায়। এতে ফলন মারাত্বকক ভাবে কমে যায়। এ পোকার আক্রমণের অন্যতম লক্ষণ হল, আক্রান্ত গাছের নিচে দিয়ে হাঁটলে পোকা লাফিয়ে গায়ে পড়ে।
দমন ব্যবস্থা: এ পোকা দমন করতে হলে মুকুল আসার আগে অথবা মুকুল আসার সময় থেকে নিম্নলিখিত কীটনাশক স্প্রে করতে হবে:
ডায়াজিনন ৬০ ইসি বা লেবাসিড ৫০ ইসি চা চামুচের ৪ চামুচ ৮.৫ লিটার জলে মিশিয়ে ১৫ দিন পর পর ২ বার স্প্রে করতে হবে। অথবা ম্যালাথিয়ন বা এম.এস.টি ৫৭ ইসি উপরোক্ত মাত্রায় স্প্রে করতে হবে।
এছাড়াও লিচু চাষে কিছু সমস্যা, রোগ পোকা দেখা দেয়। যা নিয়ে সরাসরি কৃষি বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারেন।